জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি ও কারসাজির অভিযোগ এনে বর্জন করেছে ছাত্রদলসহ পাঁচটি প্যানেল। একই অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনের পাঁচ সদস্যের মধ্যে দুজন পদত্যাগ করেছেন। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর বিভিন্ন কেন্দ্রে অসংগতির অভিযোগ তুলছেন শিক্ষার্থী ও প্রার্থীরা।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জাহানারা ইমাম হল, শহীদ রফিক-জব্বার হল ও মওলানা ভাসানী হলের ভোটের ফলাফলে বেশ অসংগতি রয়েছে।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সংসদের ২৫ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ১৭৭ জন এবং ২১টি হল সংসদের ৩১৫ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ৪৪৩ জন প্রার্থী।
শহীদ রফিক-জব্বার হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিন সম্পাদক পদে চারজন প্রার্থী মোট ৫১৩ ভোট পেয়েছেন, অথচ পুরো হলে ভোট পড়েছে ৪৬৯টি। বিজয়ী হিসেবে আশরাফুল ইসলামের নাম ঘোষণা করা হলেও পরে হল প্রভোস্ট মোবাইল ফোনে বলেন, ‘তুমি জয়ী হওনি, গণনায় ভুল হয়েছে। আমরা দুঃখিত।
প্রার্থী আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘কমিশনের লাইভ ঘোষণায় আমি জয়ী হয়েছিলাম। কিন্তু পরে জানানো হয় আমি ৯২ ভোট পেয়েছি। এত সময় নিয়েও ভুল ফলাফল প্রকাশ অত্যন্ত দুঃখজনক ও রহস্যজনক।’
হল প্রভোস্ট অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার জয় বলেন, ‘দুটি ট্যালিতে ভোটগণনা হয়েছে।
সেখানে ইংরেজি ৪ এবং ৮ সংখ্যা গুলিয়ে ফেলায় এ ভুল হয়েছে।’ জাহানারা ইমাম হলের রিটার্নিং অফিসারের তথ্য মতে, ভোট পড়েছে ২৪২টি। কিন্তু কমিশনের ফলাফলে উল্লেখ করা হয়েছে ২৪৭টি ভোট পড়েছে। এজিএস পদে দুই প্রার্থী লামিয়া জান্নাত ও সাদিয়া খাতুন সমান ১১৩টি করে ভোট পান। একটি ভোট টিক চিহ্ন বক্সের বাইরে থাকায় বাতিল করা হয়, যদিও অন্য হলে এমন ভোট গ্রহণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
লামিয়া জান্নাত বলেন, ‘আমি ১১৪ ভোট পেয়েছি, কিন্তু একটি ভোট বাতিল করা হয়েছে। অথচ একই রকম পরিস্থিতিতে অন্য হলে সে ভোট বৈধ ধরা হয়েছে।’
তাঁর পোলিং এজেন্ট শাহানা তামান্না সাথী বলেন, ‘রিটার্নিং অফিসার বলেছিলেন, পরে জানাবেন, কিন্তু আর কিছু বলেননি।’
রিটার্নিং অফিসার নাসরিন খাতুন বলেন, ‘কমিশন থেকে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে টিক পড়লে ভোট বাতিল করতে হবে।’ তবে অন্য হলে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে বলে জানা গেছে।
মওলানা ভাসানী হলের ভোট বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সদস্য প্রার্থী নীহ্লা অং মারমা পেয়েছেন শূন্য ভোট। এই ফল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তোলেন রেলং খুমি নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘আমি নিজে নীহ্লাকে ভোট দিয়েছি, সতর্কভাবে টিক দিয়েছি। তাহলে সে শূন্য ভোট পেল কিভাবে?’ রেলং বলেন, ‘হলটিতে আদিবাসী কমিউনিটির অনেক শিক্ষার্থী থাকলেও একজন প্রার্থী শূন্য ভোট পেয়েছেন—এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটা গাফিলতি নাকি কারচুপি, তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ভোট গণনায় ভুল হয়েছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব রিটার্নিং অফিসারদের। এ নিয়ে লিখিত অভিযোগ দিতে হবে জাকসুর সভাপতি উপাচার্যের কাছে।’
প্রো-ভিসির নির্দেশে ১০ শতাংশ ব্যালট কেটে রাখার অভিযোগ : বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রো-ভিসি (শিক্ষা) রিটার্নিং অফিসারকে ১০ শতাংশ ভোট কেটে আলাদা রাখতে বলেন। প্রো-ভিসি জামায়াতপন্থী, তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানও পরিবর্তিত। এ ধরনের একজন ব্যক্তিকে নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রাখা অনুচিত।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের শুরুর দিকে অনিয়ম হবে না বলে আশ্বস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে অতিরিক্ত ব্যালট পেপার বিতরণ করা হয়েছে।’
অতিরিক্ত ভোটার ও ভোটের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন : অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও গড় ভোটদানের হার হয়েছে ৭০ শতাংশ। এটা অস্বাভাবিক। হল প্রাধ্যক্ষরা নিজেরাই বলেছেন, ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী হলেই ছিল না। তাহলে এই ২০ শতাংশ অতিরিক্ত ভোটার কারা?’
তিনি প্রকাশ্যে ভোট গণনা ও সিসিটিভি ফুটেজ যাচাইয়ের দাবি জানান।
শিক্ষক নেটওয়ার্কের নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ৩৩ বছর পর আয়োজিত জাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ জাগালেও এটি ত্রুটিপূর্ণ ও বিতর্কিত ছিল। শুরু থেকেই অব্যবস্থাপনা, পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত ও জনবল ঘাটতি লক্ষ করা গেছে।
বিবৃতি নিয়ে বিভ্রান্তি জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামে : জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের নামে দেওয়া এক বিবৃতিতে নির্বাচনের অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি জানানো হলেও ফোরামের দুই সদস্য এতে অবগত ছিলেন না বলে জানিয়েছেন।
প্রক্টর ও সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক রাশিদুল আলম বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না।’
সাবেক দপ্তর সম্পাদক ও প্রভোস্ট অধ্যাপক রেজাউল রাকিব বলেন, ‘আমি পরে বিবৃতি সম্পর্কে জানতে পেরেছি। বিষয়টি নিয়ে ফোরামের বৈঠকে আলোচনা হবে।’
পদে জয় পেলেও সিদ্ধান্তহীনতায় ছাত্রদল : নির্বাচন বর্জন করলেও ছাত্রদল-সমর্থিত প্রার্থীরা ২১টি হল সংসদের ৩০টি পদে জয় পেয়েছেন। তবে তাঁরা দায়িত্ব নেবেন কি না, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে আলোচনা করব। সিদ্ধান্ত তাঁরাই নেবেন।’