অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু ঢাকাসহ সারা দেশে তাদের মিছিল বেড়েই চলেছে। দেশের বাইরে দলটির কিছু নেতা-কর্মীকে সরকার-সংশ্লিষ্টদের হেনস্তা করতে দেখা গেছে। হঠাৎ করে কেন আওয়ামী লীগের মিছিল বাড়ছে, পুলিশ কেন নীরব থাকছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের মিছিল সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ঢাকায়। প্রায় প্রতিদিনই একাধিক ঝটিকা মিছিল হচ্ছে। আর প্রতিটি মিছিলের পরই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ তাদের অন্য সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ফেসবুক পেজে মিছিলের ভিডিও প্রকাশ করছে। আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের মাধ্যমেও সেসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে সাধারণত বাংলাদেশের মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে তাদের ঝটিকা মিছিলের খবর বা ছবি প্রকাশ করা হয় না। তবে কিছু অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেগুলো প্রকাশ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও তাদের নিয়ন্ত্রিত ফেসবুক পেজগুলোতে ওইসব মিছিলের ভিডিও দ্রুতই ‘আপ’ করা হচ্ছে। জানা গেছে, সম্প্রতি আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের মিছিল বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ বেড়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের।
আজ শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) জুমার নামাজের পর অন্তত ৬টি পয়েন্টে মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন। কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, কাকরাইল, মতিঝিল, ধানমণ্ডি, উত্তরায় মিছিলের কথা জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) ঢাকার হাজারীবাগের বেড়িবাঁধ এলাকায় আওয়ামী লীগের একটি ঝটিকা মিছিল বের হয়। মিছিলের পর ১১ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
তার আগে মঙ্গলবার শ্যামলী এলাকায় আওয়ামী লীগের মিছিল থেকে পুলিশ কয়েকজনকে আটক করলেও মোটরসাইকেলে আরেকটি দল এসে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতের চেষ্টা করে। পরে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণ করা হয় বলেও অভিযোগ।
শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইমাউল হক বলেন, “তারা মিছিলের প্রস্তুতি নিতে গেলে আমরা প্রথমে চারজনকে আটক করি। তাদের মধ্যে একজন ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর মোটরসাইকেলে আরেকটি গ্রুপ এসে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করলে সেখান থেকে আরো একজনকে আটক করা হয়। কাউকে তারা ছাড়িয়ে নিতে পারেনি।”
গত ৫ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা রাজধানীর ধানমণ্ডি ও তেজগাঁওয়ে একযোগে তিন জায়গায় ঝটিকা মিছিল করে। তেজগাঁওয়ের নাবিস্কো মোড় ও জিএমজি মোড় এবং ধানমণ্ডির ৪/এ সড়ক তিন এলাকায় দুপুরের পর মিছিল করে তারা।
ঢাকায় প্রায় প্রতিদিনই হচ্ছে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল। ঢাকার বাইরেও হচ্ছে। শুধু দিনে নয়, রাতেও হচ্ছে এমন মিছিল। গত ১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঢাকার মতিঝিলের দিলকুশা ডিবিএল ভবনের সামনে ঝটিকা মিছিল করেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। পুলিশ সেখান থেকে পাঁচজনকে আটক করে।
এর তিন দিন আগে, ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে বাংলামোটর ও গুলশানে ঝটিকা মিছিল করার সময় ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার আগে ৯ সেপ্টেম্বর মিরপুর দারুসসালাম এলাকায় ঝটিকা মিছিলের পর আওয়ামী লীগের ১৮ জনকে আটক করা হয়। ঢাকার প্রতিটি এলাকায়ই ইতিমধ্যে কমপক্ষে একবার করে ঝটিকা মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও তাদের ঝটিকা মিছিল হচ্ছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-র উপ-কমিশনার মো. তালেবুর রহমান বলেন, “গত ১৫ দিনে ঝটিকা মিছিল করার অপরাধে আমরা কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ১৩০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছি। তবে তারা কতগুলো ঝটিকা মিছিল করেছে সেই হিসাব আমাদের কাছে নেই।”
ঝটিকা মিছিল থেকে শ্যামলীতে পুলিশের ওপর হামলার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, “তারা হামলা করেছিল, কিন্তু কাউকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি।”
ঢাকা শহরে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১৯ দিনে ৪৮টি ঝটিকা মিছিল হয়েছে বলে দাবি করেছেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠনটির আত্মগোপনে থাকা এক নেতা। বলেন, “গত মাসে এত হয়নি। চলতি মাস থেকে আমরা ঝটিকা মিছিল বাড়িয়ে দিয়েছি। অক্টোবরে আরো বাড়বে।” তবে সারা দেশে চলতি মাসে কতগুলো ঝটিকা মিছিল হয়েছে তার প্রকৃত সংখ্যা তিনি জানাতে পারেননি।
বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, এমন ঝটিকা মিছিলের জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে। কাজের সুবিধার জন্য নিজস্ব যোগাযোগ চ্যানেলও গড়ে তুলেছেন তারা। প্রতিটি মিছিলের একটি অগ্রবর্তী দল থাকে। তারা আগে রেকি করে পরিস্থিতি জানানোর পর মিছিল বের করা হয়। ইদানীং মিছিলে মোটরসাইকেল আরোহীদের একটি দলও থাকে। খুব অল্প সময়ের জন্য মিছিল করে তা মোবাইল ফোনে ধারণ করে দ্রুত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেন তারা। মিছিল শেষ করে খুব দ্রুত সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যান তারা। যাবার সময় হাতের ব্যানার ফেলে যান তারা। জানা গেছে, ফেলে যাওয়া ব্যানারগুলো তারা নিজেরাই তৈরি করার চেষ্টা করেন।
ঢাকার কয়েকটি থানার ওসির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা এখন সব সময় এই ঝটিকা মিছিল নিয়ে টেনশনে থাকেন। সন্দেহজনক মনে হলে নিয়মিত বাসা-বাড়ি ও মেসবাড়িতে অভিযানও চালাচ্ছেন তারা। একাধিক ওসি দাবি করেন, আওয়ামী লীগের এক এলাকার নেতা-কর্মীরা অবস্থান পরিবর্তন করে আরেক এলাকায় চলে গেছে। বাইরে থেকে আসা সবচেয়ে বেশি নেতা-কর্মী এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন বলেও মনে করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তারা।
উপ-কমিশনার তালেবুর রহমান বলেন, “আসলে তারা এখন সংখ্যায় ঠিক কতজন আছে সেই হিসাব আমাদের কাছে নেই। তবে আমরা নিয়মিত নজরদারি করছি। তাদের চিহ্নিত করতে সাধারণ মানুষেরও সহায়তা নিচ্ছি।”
আর পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, “সারা দেশেই আমরা এই ঝটিকা মিছিল দেখতে পাচ্ছি। তবে গত এক মাসে কত ঝটিকা মিছিল বের হয়েছে সারা দেশে, কতজন আটক হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব আমাদের কাছে নেই। তবে আটক হচ্ছে।”
ঢাকায় ঝটিকা মিছিল থেকে যাদের আটক করা হয়, তাদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কারো কারো বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনেও মামলা হচ্ছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা তালেবুর রহমান।
আওয়ামী লীগের এসব ঝটিকা মিছিল নিয়ে সরকারও উদ্বিগ্ন। গত ৭ সেপ্টেম্বর যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ উপদেষ্টা বৈঠক করেন। বৈঠকে ঝটিকা মিছিলসহ বেআইনি সমাবেশের বিষয়ে মনিটরিং জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া এর নেপথ্যে যারা সক্রিয় রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়।
এদিকে পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীর কোনো থানা এলাকায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল হলে জবাবদিহি করতে হবে সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)-সহ পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের। পরিদর্শকদের থানা থেকে প্রত্যাহারও করা হবে বলে জানান তিনি। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)-র ৫০ থানার ওসি ও পরিদর্শকদের ইতিমধ্যে তা জানানো হয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, ডিএমপির কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী গত রবিবার রাত ৯টার দিকে বেতারযন্ত্রে ৫০ থানার ওসি ও পরিদর্শকদের উদ্দেশে এই বার্তা দেন। বার্তায় বলা হয়, যেসব থানা এলাকায় ঝটিকা মিছিল হবে, সেই থানার ওসিসহ সবাইকে সে বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। দায়িত্বে অবহেলা ও শিথিলতার কারণে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হবে তাদের।
মিছিল কি থামানো যাবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদের স্পষ্ট কথা, “এই ঝটিকা মিছিল থামানো যাবে না। এটা সামনে আরো বাড়তে পারে।” তিনি আরো বলেন, “এখানে তো একটা গ্রে এরিয়া আছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দল তো নিষিদ্ধ করা হয়নি। আর তাদের তো লাখ লাখ নেতা-কর্মী আছে। তারা তো দেশ ছেড়ে যায়নি। দেশের বাইরেও আছে। দেশে-বিদেশে সবখানেই তারা সক্রিয় হবে।”
তার কথা, “আসলে পুলিশ কয়জনকে আটক করবে? তারা তো আটক হতে পারে জেনেই মিছিল করছে। রাজনৈতিক দলগুলোও ভোটের হিসাব করে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে না। তাদের ভোট বিএনপি চায়, জামায়াতও চায়। আর তাদের নিষিদ্ধ করার পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তো দ্বিমত আছে।”
তিনি আরও বলেন, “দলটির তো শক্তি আছে। অর্থ আছে। বিদেশেও তাদের শক্তি আছে। তাই এভাবে নয়, যারা অপরাধ করেছে, তাদের বিচারের ব্যবস্থা করুন। সবাইকে তো নিষিদ্ধ করা যাবে না। দেশে রাজনৈতিক সংকট যত বাড়বে, আওয়ামী লীগ আরো সক্রিয় হবে। ঠেকানো যাবে না।”
সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, “পুলিশের চেয়ে ঝটিকা মিছিল যারা করেন, তাদের সংখ্যা যদি বেশি হয়, তাহলে তো পুলিশ পারবে না। ঝটিকা মিছিলকারীরা তো সংখ্যায় অনেক বেশি। তাদের মিছিল যদি বাড়তে থাকে, তাহলে মনে করবেন, জনগণের সাথে তাদের একটা মনস্তাত্ত্বিক সংযোগ আছে।”
তার কথা, “নির্বাহী আদেশে কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে ওই দলটিকে শেষ করা যায় না। দেশের জনগণ যদি ওই দলকে প্রত্যাখ্যান না করে, নিশ্চিহ্ন না করে, তাহলে নিশ্চিহ্ন হয় না। দলটি আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে। ইতিহাসে তার প্রমাণ আছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌহিদুল হক মনে করেন, “আসলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে অনৈক্য তৈরি হয়েছে, তার সুযোগ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এই অনৈক্য যদি আরো বাড়ে, তাহলে আওয়ামী লীগের ফিরে আসা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।”
তার মতে, “যেভাবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা-ও সঠিক প্রক্রিয়া নয়। আসলে বিচারের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।”
তথ্যসূত্র: ডয়েচে ভেলে