হত্যা, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, জমি দখল, মানবপাচার ও ডাকাতি এমন অন্তত দেড় ডজন মামলার আসামি দুর্ধর্ষ এ সন্ত্রাসী হলেন জরিফ মিয়া ওরফে কালা জরিফ (৪৮)। এর মধ্যে কয়েকটি মামলা এখনও বিচারাধীন। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মানুষ। তবু রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কিছুদিন আত্মগোপনে থাকলেও পরে এলাকায় ফিরে আবারও ত্রাস চালাতে শুরু করেন।
তিনি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের হাসনাবাদ ইকুরিয়া এলাকার মৃত সোহরাব উদ্দিনের ছেলে।
দুই দশক আগে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কুখ্যাত ‘আনসার বাহিনীর সদস্য ছিলেন কালা জরিফ। ২০০৩ সালে বাহিনীর প্রধান আনসার মিয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর নেতৃত্বে আসেন জরিফ। পরে নিজ নামে গঠন করেন ‘জরিফ বাহিনী’।
সেই থেকে তার নেতৃত্বে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়ে আসছে।
জরিফ মিয়ার বাবা সোহরাব উদ্দিন ছিলেন মিলের কর্মচারী। পরে পুরাতন ঢাকার শ্যামপুরে ব্যবসা করতেন। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা জরিফ বর্তমানে কোটি কোটি টাকার মালিক। স্থানীয়দের অভিযোগ, হত্যা, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, জমি দখল, মানবপাচার ও ডাকাতির মাধ্যমে তিনি বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন।
জরিফের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অন্তত দেড় ডজন মামলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে পুনরায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা তাদের কাজে বাঁধা দিলে জরিফ ও তার সহযোগীরা তাঁদের প্রাণনাশের হুমকি দেন। তার নামে দায়ের করা মামলায় যারা সাক্ষী হিসেবে ছিলেন প্রতিনিয়ত তাঁদের ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে ও মদদে জরিফ এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীন আহমেদের প্রশ্রয়ে জরিফ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন।
সম্প্রতি কালা জরিফ রিভালভার হাতে প্রকাশ্যে গুলি ছোঁড়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারাও বলছেন, সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের সমন্বয়ে তিনি জরিফ বাহিনী গড়ে তুলেছেন। তার বাহিনীতে প্রায় শতাধিক সক্রিয় সদস্য রয়েছে। জরিফের অন্যতম সহযোগী হলেন মো. আনিস (৪৪), জেহাদ আলি (৪৮), মো. আব্দুল্লাহ (৪৫), আনোয়ার হোসেন (৪৪), মোতালেব মিয়া ওরফে মোতাইল্লা (৫২) ও সুমন হোসেন (৩৮)। এছাড়া সাদ্দাম (২৫) ও আল আমিনের (৩৫) নেতৃত্ব দেন জরিফের কিশোর গ্যাংকে। যেখানে ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী অর্ধশতাধিক তরুণ রয়েছেন। এই বাহিনী মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, জমি দখল, ছিনতাই ও কেবল টেলিভিশন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে।
ভুক্তভোগী পরিবার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে এক ছাত্রীকে অপহরণ করে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জরিফ ও তার সহযোগীরা। ২০১২ সালের ১৬ মার্চ হাসনাবাদ ইকুরিয়া এলাকায় এক গৃহবধূর বাসায় ঢুকে তাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে জরিফের সহযোগীদের বিরুদ্ধে। একই বছরের ১৪ মে ইকুরিয়া এলাকার ব্যবসায়ী হেলাল উদ্দিনকে রাস্তা থেকে অপহরণ ও কুপিয়ে জখম করার অভিযোগে জরিফের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়। ২০১৩ সালের ইকুরিয়া মুসলিমনগর এলাকার মাসুম আহমেদ ওরফে সুমন (৩২) কে জবাই করে হত্যার ঘটনায় জরিফ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়। একই বছর হাসনাবাদ হাউজিং এলাকায় আব্দুর রহিম (৪৫) নামের এক ব্যক্তির জমি দখলের অভিযোগ উঠে জরিফের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় ভুক্তভোগী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। ২০২১ সালে ইকুরিয়া বাজার এলাকায় এক গৃহবধূকে কাঁটা চামচ দিয়ে আঘাত করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জরিফ ২নং আসামি ছিলেন। ২০২২ সালে অস্ত্র, মাদক ও জাল নোট উদ্ধারের ঘটনায় টঙ্গী থানায় জরিফের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০২৩ সালে র্যাব বাদী হয়ে জরিফের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা দায়ের করেন। চলতি বছরের ২ এপ্রিল ইকুরিয়া জিরো পয়েন্ট এলাকায় ডেকোরেটর ব্যবসায়ী জরিপ হোসেন (৫০) নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জরিফ বাহিনীর সদস্যদের নামে মামলা দায়ের করা হয়।
২০২২ সালে ৬ সেপ্টেম্বর শুভাঢ্যা ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্যে মো. ওহেদুজ্জামানের করা চাঁদাবাজি মামলায় পুলিশ জরিপ গ্রেপ্তার করে আদালতের নির্দেশে কারাগারে প্রেরণ করে। ২০২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ সুপার মার্কেটে অভিযান চালিয়ে জরিফকে তার তিন সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব-১০ এর সদস্যরা। ওই সময় তার কাছ থেকে বিদেশী পিস্তল, মাদক ও বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র ও মানবপাচার নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করে র্যাব।
সম্প্রতি শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. ওহেদুজ্জামানের মেয়ের নামে কেনা জমি দখলের চেষ্টা করেন কালা জরিফ। পরবর্তীতে তিনি নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এ ঘটনায় কোন প্রতিকার না পেয়ে গত বৃহস্পতিবার ওহেদুজ্জামান জরিফের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার নেওয়ার দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন।
মো. ওহেদুজ্জামান ইত্তেফাককে বলেন, ২০০২ সাল থেকে আমি শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি। জরিফ ব্যবসা-বাণিজ্য কিছু্ই করেন না। সে এলাকায় চাঁদাবাজি, জমি দখল ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। ইকুরিয়া এলাকার তার পাঁচতলা ও ছয় তলা বিশিষ্ট দুটি ভবন রয়েছে। তিনি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের অন্তত ৩০ বিঘা জমি দখল করেছে। এছাড়া নামে-বেনামে বিভিন্ন জায়গায় জমি রয়েছে। তার টাকার কোনো অভাব নেই। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে জরিপ এত টাকার মালিক বনে গেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে জরিফের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এদিকে গত বুধবার ইকুরিয়া এলাকায় জরিফ মিয়া সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, আমি ওহেদুজ্জামানের জমি দখল করিনি। আমার কাছে ওই জমির বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। বরং ওয়ার্ড সদস্য ওহেদুজ্জামান আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও অভিযোগ দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ মোহাম্মদ আখতার হোসেন বলেন, ওয়ার্ড সদস্য ওহেদুজ্জামান ও জরিপ দুজনই একে অপরের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। তাদের জিডি তদন্তের জন্যে আদালতের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। অনুমতি পেলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জরিফের বিরুদ্ধে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে কিনা জানতে চাইলে ওসি বলেন, তার জানা মতে বর্তমানে কোনো মামলায় পরোয়ানা নেই।