কুড়িগ্রাম-২ আসনে নির্বাচনি হাওয়া বইছে জোরেশোরেই। জাতীয় পার্টির অপ্রতিরোধ্য দুর্গ হিসেবে পরিচিত কুড়িগ্রাম-২ আসন। জেলা সদরের এই আসন ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ। দীর্ঘদিন ধরে আসনটি জাতীয় পার্টির (জাপা) দখলে থাকলেও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে আসনটি দখলে নিতে মরিয়া দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি।
অতীতে প্রয়াত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ থেকে শুরু করে দলের একাধিক প্রার্থী এ আসনে জয়ী হয়েছেন। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর অভাবনীয় বিজয়ের পর জাপার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যায়। এবার আসনটি দখলে নিতে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামছে বিএনপি। এ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। যদিও রুহুল কবির রিজভী এ বিষয়ে কিছুই বলেননি।
ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিস তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। বিএনপির প্রার্থী হিসাবে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীসহ কয়েকজনের নাম শোনা যাচ্ছে। দল ও জোটের প্রার্থীর ওপর এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধরন নির্ধারিত হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা। এককভাবে নির্বাচন করলে চতুর্মুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা আছে।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির দুর্গখ্যাত এই আসনটি কবজা করতে তৎপর চারটি রাজনৈতিক দল। যদিও জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা একেবারে নড়বড়ে। তারপরও দলটি নির্বাচনে অংশ নিলে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারে। কুড়িগ্রাম সদর, ফুলবাড়ী ও রাজারহাট উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম-২ আসন। এ আসনে ২১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় মোট ভোটার ৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৮০ হাজার ৭৩৬, নারী ২ লাখ ৮৬ হাজার ৪৬৩ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার তিনজন।
এ আসনে ২০০১ সালে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ২৩ হাজার ৮৮৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী তাজুল ইসলাম চৌধুরী। ২০০৮ সালে দলটির সাবেক চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ২ লাখ ৯ হাজার ৫০৫ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। এরশাদ আসনটি ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাফর আলী ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৪৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। পরে ২০১৪ সালে তাজুল ইসলাম চৌধুরী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফের নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে জাতীয় পার্টির প্রার্থী পনির উদ্দিন আহমেদ লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ভোট পেয়ে আসনটি দলের দখলে রাখেন। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে পনির উদ্দিন আহমেদকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে দেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. হামিদুল হক।
রুহুল কবির রিজভী ২০০৬ সালের বাতিল ঘোষিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে দলের প্রার্থী ছিলেন। এবারও তিনি প্রার্থী হতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। তিনি ছাড়াও জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম বেবু, যুগ্ম আহ্বায়ক হাসিবুর রহমান হাসিব, সাবেক এমপি উমর ফারুখ, সাবেক পৌর মেয়র আবু বকর সিদ্দিক সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন। এর মধ্যে সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ দীর্ঘদিন নির্বাচনি এলাকার আনাচে-কানাচে জনসংযোগ করছেন। বর্তমানে এর গতি আরও বাড়িয়েছেন। শফিকুল ইসলাম বেবু ও হাসিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা। তারা পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছে ছুটে যাচ্ছেন। নিয়মিত সভা-সমাবেশ করছেন। জনসংযোগ করছেন উমর ফারুখও।
আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী অ্যাডভোকেট ইয়াছিন আলী সরকার, ইসলামী আন্দোলন অধ্যক্ষ মাওলানা নুর বখত মিয়া, এনসিপি ড. আতিক মুজাহিদ ও খেলাফত আন্দোলন মুফতি নুরুদ্দীন কাশেমীকে প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচনকে টার্গেট করে এলাকায় নানাভাবে গণসংযোগ করছেন তারা। অংশ নিচ্ছেন রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে। অনেকে পোস্টারের মাধ্যমেও প্রচার চালাচ্ছেন। জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে সাবেক এমপি পনির উদ্দিন আহমেদ ও মেজর (অব.) আব্দুস সালামের নাম শোনা গেলেও মাঠে তাদের কোনো তৎপরতা নেই। গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে।
এ বিষয়ে সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শহর ও গ্রামের প্রতিটি কোণে গিয়ে দলের কর্মসূচি প্রচার এবং মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে ছিলাম। আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের কাতারে থেকে ফ্যাসিস্ট সরকারের দেওয়া মামলা ও অত্যাচার সহ্য করেছি। দলকে সংগঠিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছি। আশা করি, আমার ত্যাগ ও জনপ্রিয়তা দল মূল্যায়ন করবে।
শফিকুল ইসলাম বেবু বলেন, নদী ও চরবহুল এই জেলায় আমরা চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে চরবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবিতে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ করছি। জেলার উন্নয়ন আন্দোলনে মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি।
জামায়াতের প্রার্থী অ্যাডভোকেট ইয়াছিন আলী সরকার বলেন, কুড়িগ্রাম একটি দারিদ্র্যপীড়িত জেলা। আমি নির্বাচিত হলে একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা, দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও বেকার ভাই-বোনদের বেকারত্ব দূর করতে বন্ধ টেক্সটাইল মিলটি পুনরায় চালু, নদীশাসন করে ধরলা নদীতে ধরলা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়নসহ নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দারিদ্র্য ঘুচানোর চেষ্টা করব।
এনসিপির প্রার্থী ড. আতিক মুজাহিদ বলেন, কুড়িগ্রাম অনুন্নত ও অবহেলিত এলাকা। আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার এই এলাকার মানুষ। তবে এ বঞ্চনার জন্য শুধু সরকার দায়ী নয়, দীর্ঘ ৫৪ বছরে যারা জনপ্রতিনিধি ছিলেন, তারা মানুষের ভাগ্যবদলে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেননি। এই বঞ্চনা ও বৈষম্য ঘোচানোর জন্য তরুণ নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই।
ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মাওলানা নুর বখত মিয়া বলেন, দ্বিতীয় চরমোনাই খ্যাত কুড়িগ্রামে ইসলামী আন্দোলনের বিরাট ভোটব্যাংক রয়েছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত থাকা ও ব্যক্তি ইমেজের জন্য আশাতীত সাড়া পাচ্ছি। জনগণ সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারলে আমার বিজয় হবে ইনশাআল্লাহ।