যেসব সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) দিয়েছিল, সেগুলোসহ প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু পরে সনদ বাস্তবায়নের আদেশের খসড়ায় ঐকমত্য কমিশন নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রাখেনি। সনদে স্বাক্ষরকারী বিএনপি একে ‘প্রতারণা’ বলে উল্লেখ করেছে। তারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ কয়েকটি দল সনদ বাস্তবায়নের আদেশে নোট অব ডিসেন্ট না রাখাকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা বলছে, সংলাপের সময় যখন নোট অব ডিসেন্ট গ্রহণ করা হয়েছিল, তখন গণভোটের সিদ্ধান্ত ছিল না। তখন আলোচনা হয়েছিল, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে এর ফয়সালা হবে। যে দল ক্ষমতায় যাবে, তারা নিজেদের নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে না। গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিএনপি গণভোটের বিষয়ে একমত হয়। এই দলগুলো বলছে, কোনো প্রস্তাব গণভোটে পাস হলে নোট অব ডিসেন্ট আর গুরুত্ব পেতে পারে না।
দলগুলোর বিতর্কের মধ্যে ঐকমত্য কমিশন বলেছে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) আদেশ ২০২৫’-এর দুটি খসড়ায় নোট অব ডিসেন্ট রাখা হয়নি। তবে সরকারকে যে সুপারিশ দেওয়া হয়েছে, তাতে পুরো জুলাই সনদ যুক্ত আছে। আর জুলাই সনদে নোট অব ডিসেন্ট আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে আদেশের খসড়ায় নোট অব ডিসেন্ট রাখা হয়নি।
সনদে সংস্কারের এমন ৪৮ প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। আর গণভোট হবে একটি প্রশ্নে। তাই নোট অব ডিসেন্ট গণভোটে না রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশনের একাধিক সদস্য গতকাল সমকালকে বলেছেন, এ সুপারিশ গৃহীত হলেও আগামী সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নোট অব ডিসেন্ট অনুযায়ী সংস্কারের এখতিয়ার থাকবে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলের মতামত এবং বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পরামর্শে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়ে খসড়ায় নোট ডিসেন্ট রাখেনি। সুপারিশের সঙ্গে যুক্ত সনদে তা রয়েছে। এখন এ বিষয়ে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা সরকার নেবে। কমিশনের আর কোনো মতামত নেই।
সুপারিশ অনুযায়ী, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ গণভোটে অনুমোদিত হলে আগামী নির্বাচনে সংসদ এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে। এমপিরাই হবেন পরিষদের সদস্য। সংসদ এবং পরিষদ একসঙ্গে চলবে। পরিষদ সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার করবে।
গণভোট আয়োজনে অধ্যাদেশ জারির সুপারিশ করলেও, গণভোট কবে হবে এবং আদেশ কে জারি করবে– এই সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে বলেছে কমিশন। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, তাদের এই সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে উপদেষ্টা পরিষদে যাবে। সেখানে আদেশের খসড়া এবং সুপারিশের কতটা গ্রহণ করা হবে, তা ঠিক হবে।
অধিকাংশ প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট
জুলাই সনদে সংস্কারের ৮৪টি প্রস্তাব রয়েছে। এর ৬১টিতে কোনো না কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবের একাধিক ধাপ রয়েছে। বিভিন্ন ধাপসহ হিসাব করলে, নোট অব ডিসেন্টের সংখ্যা শতাধিক। সবচেয়ে বেশি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বামপন্থি দলগুলো। ৯ মৌলিক সংস্কারসহ ১৫ সংস্কারে বিএনপি ভিন্নমত জানিয়েছে। জামায়াত সাতটি এবং এনসিপি দুটি সংস্কার প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে ৩০ রাজনৈতিক দল ও জোট অংশ নেয়। ১৬৬ সংস্কারের প্রস্তাব আলোচিত হয়। এর ৮২টি বাদ পড়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তিতে। যেসব সংস্কারের সুপারিশে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দল একমত হয়, সেগুলোই সনদে রাখা রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ঐকমত্য ঘোষণা করে কমিশন। এ সিদ্ধান্তে কোন কোন দলের ভিন্নমত রয়েছে, তাও উল্লেখ রয়েছে প্রস্তাবগুলোতে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যের উদাহরণ দিয়ে বিএনপি গত জুন থেকেই বলছে, যেসব প্রস্তাবে সব দল একমত, সেগুলোতেই ঐকমত্য হয়েছে বলে গণ্য হবে। বিএনপির সমমনা দলগুলোর একই অবস্থান। তবে জামায়াত ও এনসিপি বলছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে গ্রহণ করতে হবে।
নোট অব ডিসেন্ট বিতর্ক
বিএনপি আগেই জানিয়েছে, পিআর পদ্ধতি সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতি, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগসহ যেসব সংস্কার প্রস্তাবে তারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, নির্বাচনে জয়ী হলে তা বাস্তবায়ন করবে না। দলটির দাবির মুখে গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরের আগের দিন জুলাই সনদে নোট অব ডিসেন্ট যুক্ত করা হয়। সনদে পাদটিকা যুক্ত করে বলা হয়, যে সংস্কারে যে দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, নির্বাচনী ইশতেহারে তা রেখে জয়ী হলে আগামী সংসদে সেভাবে বাস্তবায়নের এখতিয়ার রাখবে তারা।
জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল বলছে, দু-একটি দলের নোট অব ডিসেন্টের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত বাদ যেতে পারে না। আদেশে ও গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট রাখা যাবে না। কোথাও গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট রাখার নজির নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ গতকাল বুধবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, কিছু দলের প্রস্তাব এবং ঐকমত্য কমিশনের নিজস্ব চিন্তাভাবনা জাতির ওপরে জবরদস্তিভাবে আরোপ করার প্রচেষ্টা চলছে। এ জন্যই বলতে বাধ্য হচ্ছি, যে দলিলটা প্রকাশিত হয়েছে, সেই দলিলের সঙ্গে ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাক্ষরিত দলিলটার মিল নেই। শুধু আছে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব।
প্রতারণার অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিস্ময়ে দেখলাম, বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি ছিল সনদে, তা বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এটি ঐক্য হতে পারে না।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেছেন, ‘নোট অব ডিসেন্টের মানে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে আমার ভিন্নমত রয়েছে। কিন্তু মেনে নিচ্ছি। আদালতের তিনজন বিচারকের দুজন সিদ্ধান্ত দেন, সেটাই রায়। ভিন্নমত পোষণকারী বিচারকের বক্তব্য রায়ে থাকে। কিন্তু আদেশে নয়। সংলাপে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে, তাই ঐকমত্য।’ তিনি বলেন, জামায়াতেরও কয়েকটি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। কিন্তু আপত্তি সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত মেনে নিয়েছে।
জামায়াতের মতো এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিনও আদেশের খসড়ায় নোট অব ডিসেন্ট না থাকার পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, জুন এবং জুলাই মাসে যখন সংস্কারের প্রস্তাবগুলো আলোচনা হচ্ছিল, তখন নোট অব ডিসেন্ট নেওয়া হয়েছিল। কারণ, তখন আলোচনা ছিল সিদ্ধান্ত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। পরে সেপ্টেম্বরে এসেছে গণভোটের সিদ্ধান্ত। গণভোটে কীসের নোট অব ডিসেন্ট! যদি কোনো দলের নোট অব ডিসেন্টের কারণে তাদের সমর্থকরা গণভোটে ‘না’ ভোট দেন, দিতে পারেন।
কেন খসড়ায় নেই নোট অব ডিসেন্ট
কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, গত ১৭ সেপ্টেম্বরের পর সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে যখন অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, তখন আলোচনার জন্য দলগুলো ১৫ দিন সময় নিয়েছিল। ৫ ও ৮ অক্টোবরের সংলাপে যখন ঐকমত্য হয়নি, তখন দলগুলো কমিশনকে বলেছিল নোট ডিসেন্টের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে।
কমিশনের একজন সদস্য সমকালকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় ঠিক হয়েছিল, আগে সনদ সই হবে। ঐকমত্য সম্ভব না হওয়ায় কমিশন বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করবে। এই সিদ্ধান্তে ১৭ অক্টোবর দলগুলো সনদে স্বাক্ষর করেছিল। তখনও তারা জানত, বাস্তবায়ন পদ্ধতি তাদের দলের অবস্থানের মতো নাও হতে পারে।
বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ায় নোট অব ডিসেন্ট না রাখার বিষয়ে কমিশন এবং বিশেষজ্ঞ প্যানেলের দুজন সদস্য সমকালকে বলেছেন, অচলাবস্থা নিরসনে তা করতে হয়েছে। তারা সমকালকে বলেন, পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতি নিয়েই মূল বিরোধ। তাই কমিশন ৪৮ সংস্কারই গণভোটে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। জনগণ গ্রহণ না করলে সংস্কার হবে না। ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলে সংস্কারের বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে। আগামী সংসদে কোনো দল যদি পর্যাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাহলেও নিজের নোট অব ডিসেন্ট অনুযায়ী পরে সংবিধান সংশোধন করতে পারবে। এতে বাধা থাকবে না।
বাধ্যবাধকতা নিয়েও বাহাস
আদেশের প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছে, আদেশের ওপর গণভোট হবে। গণভোটে অনুমোদিত হলে আগামী সংসদের সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের (৯ মাস) মধ্যে জুলাই সনদ অনুযায়ী সাংবিধানিক সংস্কারে বাধ্য থাকবে। না করলে অন্তর্বর্তী সরকারের রেখে যাওয়া সংবিধান সংশোধনের বিল পাস বলে গণ্য করা হবে।
তবে এর আগে ৮(ঘ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিল বিবেচনা করবে পরিষদ।’ এই খসড়ায় বলা হয়েছে, গণভোট হবে আদেশ এবং সংবিধান সংশোধনের খসড়া বিলের ওপর।
খসড়ার এই বাধ্যবাধকতাকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ হাস্যকর বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু জামায়াত ও এনসিপি নেতারা স্বাগত জানাচ্ছেন।
তবে কমিশনের দ্বিতীয় খসড়ায় ৯ মাসের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। এতে বলা হয়েছে, গণভোট হবে আদেশ এবং আদেশের তপশিলে যুক্ত ৪৮ সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে। গণভোটে তা পাস হলে পরিষদও পাস করবে।
হামিদুর রহমান আযাদ এবং এনসিপির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, তারা প্রথম খসড়াকে সমর্থন করছেন।
গতকাল বুধবার যমুনায় গিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে আট খণ্ডের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছেন ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এতে কমিশনের সুপারিশ, সংলাপ, সভার কার্যবিবরণী রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, প্রতিবেদন সাধারণের জন্য সহজবোধ্য একটি ভার্সন তৈরি করতে হবে। বই আকারে প্রকাশ করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়ে বুঝতে পারে এবং অন্যদেরও বুঝাতে পারে।
এ সময় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশন সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
Bekar Barta