খেলাপি ঋণ এবং রপ্তানি আয়ের অনিয়ম: কেয়া কসমেটিক্স গ্রুপের অভিযোগ
দেশীয় চারটি ব্যাংকের কাছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান কেয়া কসমেটিক্স লি.-এর খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৭০০ কোটি টাকা। একই সময়ে, কেয়া গ্রুপের রপ্তানি আয়ের ৬৬ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ৮,০৫২ কোটি টাকা) ব্যাংকগুলো তাদের ফরেন কারেন্সি (এফসি) অ্যাকাউন্টে জমা দেয়নি। ব্যাংকগুলো দাবি করেছে, এত বড় অঙ্কের অর্থের এখন পর্যন্ত কোনো অস্তিত্ব নেই, অর্থাৎ এটি উধাও হয়েছে। এই অবস্থায় কেয়া গ্রুপ এবং ব্যাংক একে অপরের কাছে বকেয়া দাবি করে আসছে। তবে ব্যাংকগুলো ঋণ আদায় না করতে পেরে কেয়া গ্রুপকে খেলাপি ঋণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
সম্প্রতি কেয়া গ্রুপ অর্থ উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি)-কে চিঠি দিয়ে এই ঘটনার তদন্ত চেয়েছে। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে ২০০৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই অনিয়ম ঘটেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কেয়া গ্রুপ প্রথম দফায় এই সমস্যাগুলো তুলে ধরে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছিল। তবে তখন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এজন্য তারা এবার তদন্ত চেয়ে নতুন চিঠি পাঠিয়েছে। সূত্র জানায়, বিএসইসি ইতোমধ্যেই একটি নিরীক্ষা (অডিট) ফার্ম নিয়োগ দিয়ে ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে।
কেয়া গ্রুপের চিঠিতে বলা হয়েছে, রপ্তানি আয়ের বিপুল অঙ্কের ডলার এফসি অ্যাকাউন্টে না জমা হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এতে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক ও কর্মীর চাকরি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যার মধ্যে ১,০০০ প্রতিবন্ধী কর্মী রয়েছে। বিষয়টি শ্রম মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে। এছাড়া প্রায় ৫০ হাজার শেয়ারহোল্ডারের বিনিয়োগও বিপন্ন হয়েছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, তদন্ত চাওয়ায় ব্যাংকগুলো কেয়া গ্রুপের সঙ্গে সমস্ত আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে, যদিও প্রতিষ্ঠানের পর্যাপ্ত বন্ধক রয়েছে। এর ফলে মাসে গড়ে প্রায় ১ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
কেয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক পাঠান যুগান্তরকে বলেন, “আমাদের রপ্তানি আয়ের ৬৬ কোটি ডলার ব্যাংক আমাদের এফসি অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করেনি। যদি অর্থটি স্থানান্তরিত হত, ব্যাংকের কাছে থাকা প্রায় ২,৭০০ কোটি টাকার পাওনা হতো না। ব্যাংকের হিসাবের গরমিল দেশের ডলার হিসাবের জন্য গুরুতর হুমকি।” তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের ভুলের কারণে কোম্পানি ঋণখেলাপি হয়েছে এবং দেশীয় বৈদেশিক মুনাফা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রেরিত চিঠিতে কেয়া গ্রুপ উল্লেখ করেছে:
সাউথইস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০৪-২০২৩ সালে রপ্তানি: ১০১.৯৬ কোটি মার্কিন ডলার। ব্যাংক ৩৯.৪৬ কোটি ডলার এফসি অ্যাকাউন্টে জমা দেয়নি। বিপরীতে ৮০ কোটি ডলারের বিটুবি আমদানি ফোর্স লোন এবং পরে টার্ম লোনে রূপান্তরিত হয়েছে।
পূবালী ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০৭-২০২৩ সালে রপ্তানি: ২০.১৯ কোটি মার্কিন ডলার। এফসি অ্যাকাউন্টে কোনো অর্থ জমা হয়নি। বিপরীতে ৫.৩২ কোটি ডলারের বিটুবি আমদানি ফোর্স লোন ও পরে মেয়াদি ঋণে রূপান্তরিত হয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০৯-২০২৩ সালে ৭ কোটি ডলারের রপ্তানি, যার মধ্যে ৫.৮৫ কোটি ডলার এফসি অ্যাকাউন্টে জমা হয়নি। বিপরীতে ৩.৪৫ কোটি ডলারের বিটুবি আমদানি ফোর্স লোনে রূপান্তরিত হয়েছে।
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০৮-২০১৪ সালে ৬৫ লাখ ডলারের রপ্তানি, যা এফসি অ্যাকাউন্টে জমা হয়নি। বিপরীতে ৪১ লাখ ডলারের বিটুবি আমদানি ফোর্স লোন ও পরে টার্ম লোনে রূপান্তরিত হয়েছে।
সাউথইস্ট ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জানান, ব্যাংক অডিট করে দেখছে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। বিএসইসি একটি অডিট ফার্মকে তদন্তের জন্য নিয়োগ দিয়েছে, তবে রিপোর্ট এখনও জমা হয়নি।
পূবালী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য দেননি, আর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক অভিযোগকে “মিস ইনফরমেশন” বলে উল্লেখ করেছে।
অভিযোগ করা হয়েছে, এই অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রার বাধ্যবাধকতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছে।